ওয়ালিউর রহমান
যাপিত জীবনে পরশ পাথর ছিলে
সোনা ফলেছিলো যা কিছু ছুঁয়েছিলে!
পার্থিব সব গুনের আধার নিয়ে
রাঙ্গালে ভূবন সবটুকু তার দিয়ে!
মুহাম্মদ মোতাহ্হার এমন একটি ভালাবাসাপূর্ণ শ্রদ্ধাবোধের নাম, যাকে একাধারে একটি আলোক বর্তিকা, মহাকালের বিচারে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মাঝে সমসাময়ীক কালের একটি স্বর্ণালী অধ্যায়ের মতো বিশেষণ প্রদানের পরেও নিঃস্বন্দেহে বলা যায় যে, উনি নিজেই ছিলেন তৎকালীন অনগ্রসর সমাজের জন্যে প্রাতঃস্বরণীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। ক্ষণজন্মা এ মানুষটির কথা খুব সংক্ষেপে বলতে গেলেও বিশাল আকারের এক মহাকাব্য হয়ে যাবে। তবে আজকে তার সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে দু চারটি কথা বলবো। আজকের এই তরুন প্রজন্মের কাছে মৌলভি মোতাহার নামটি কেবল অজানাই নয়, একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ! অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না! ক্ষমতা, সন্ত্রাস এবং অর্থ মানদন্ডের বিচারে বর্তমান প্রজন্ম যখন মোহাবিষ্ট হয়ে কাউকে বিখ্যাত ব্যক্তি বলে বিবেচনা করে থাকে, তখন এই প্রজন্ম প্রকৃত অর্থেই জানবে কী করে আসল তারকা খচিত আলোক বর্তিকার ন্যায় সমুজ্জ্বল মানুষদের কথা? অর্থ এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেও যে একজন মানুষ উত্তম চরিত্রের আচরণ দ্বারা সমসাময়িক কালে অত্র অঞ্চলে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নিতে পারে, তা হয়তো বর্তমানের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না! মোতাহার মৌলভী সাহেব ছিলেন তেমনই একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় গুনী মানুষ। আগে পিছে কোন টাইটেল ব্যাবহার করতেন না। কিন্তু অত্র অঞ্চলের লোকজন সন্মান করে ভালবেসে উনাকে মুতাহার মৌলভী কিংবা মুতাহার মুন্সী বলে ডাকতেন। আর উনার চাচা আরেক ক্ষণজন্মা পুরুষ, জমশ্বেরপুর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আবদুর রউফ বিএল সাহেব স্নেহাষ্পদ ভাতিজা হিসাবে উনাকে আদর করে ডাকতেন মোতাহার মিয়া!
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বর্ণী গ্রামের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারটিতে জয়নুদ্দীন মুন্সীর পৌত্র হিসাবে আসহাব উদ্দিন মুন্সীর চার পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় জৈষ্ঠ পুত্র হিসাবে বিংশ শতাব্দীর শুভ সূচনা লগ্নে অর্থাৎ ১৯০০ সালের শুরুর প্রথম বর্ষে উনি জন্মগ্রহন করেন। অজাতশত্রু এই মানুষটি কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ নয় বরং ছোট, বড়, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসায় সিক্ত করে নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। বিনিময়ে সমাজের সকলের নিকট থেকে শ্রদ্ধা, সন্মান এবং ভালবাসা অর্জনের এক অনন্য অতুলস্পর্শি উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি জীবনে কারো সাথে ঝগড়া করা তো দূরের কথা, উচ্চস্বরে কোনদিন কথা বলেন নাই! বাহুল্য বর্জিত অহেতুক কোন কথাবার্তাও কারো সাথে কখনো বলতেন না। তো এমন লোকের কোনদিন শত্রু হতে পারে? তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তৎকালীন সমাজের একজন প্রকৃত “অজাতশত্রু” মানুষ!
শৈশবের প্রচন্ড মেধার চুড়ান্ত স্ফুরন ঘটিয়ে যখন ব্রিটিশ বেঙ্গল তথা অবিভক্ত বাংলা, বিহার এবং আসাম প্রদেশ নিয়ে গঠিত কলিকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধিনে অনুষ্ঠিত জুনিয়র হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় পূর্ব বঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজঁ পাড়াগাঁয়ের জমশ্বেরপুর হাই মাদ্রাসা থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন, তখন এলাকার মানুষ তথা অত্র অঞ্চলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আশেপাশের গ্রাম সহ দূর দুরান্ত থেকে সহজ সরল সাধারন মানুষগুলো আপন ঘরের সাফল্যের খুশিতে উল্লসিত হয়ে মোতাহ্হার মৌলভী সাহেবের বাড়িতে ভীর জমায়। এই অভাবনীয় সাফল্যের সময়কাল ছিলো ১৯২৩ সাল, যার প্রমান এখনো জমশ্বেরপুর স্কুলের টিচার রুমে রক্ষিত “লাইট মোর লাইট” নামের অনার্স বোর্ডে জ্বলজ্বল করে জ্বলা সর্ব প্রথম নামটি।
উনার গগনচুম্বী এই ফলাফলের সাফল্যের পেছনে যার কৃতিত্ব অনেকখানিই বলা যেতে পারে, তিনি হলেন মোতাহার সাহেবেরই কাছের আত্মীয় চাচা সম্পর্কের আরেক প্রবাদ পুরুষ জমশ্বেরপুর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আব্দুর রউফ বিএল সাহেব। উনার সার্বিক তত্বাবধানে আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের ন্যায় মোতাহার মৌলভী সাহেবকে সব সময় আগলে রাখতেন। পরবর্তীতে ঢাকা ইসলামীয়া কলেজ যেটি বর্তমানে কবি নজরুল কলেজ হিসাবে পরিচিত সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এর কিছুদিন পরেই কলিকাতা করপোরেশনে কর্মরত মোতাহ্হার সাহেবের শ্যালকের প্রচেষ্টায় কলিকাতা করপোরেশনে সেকশন অফিসার পদে চাকুরীর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মোতাহ্হার সাহেবের মা জননী পুত্র স্নেহে ব্যাকুল হয়ে কলিকাতা গিয়ে চাকুরী করার উপর তীব্র আপত্তি করেন। ফলে মাতৃভক্তির চরম পরকাষ্টা দেখিয়ে মোতাহ্হার সাহেব নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ক্যারিয়ারকে বিষর্জন দিয়ে কলিকাতা যাওয়া থেকে বিরত রইলেন। মায়ের পাশাপাশি মোতাহ্হার সাহেবের চাচা আব্দুর রৌফ সাহেবের ঐকান্তিক আগ্রহে জমশ্বেরপুর স্কুলে শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিয়োগ করেন। এর ফলস্বরূপ পর্বতসম বিশ্বস্থতায় রউফ সাহেব মোতাহার সাহেবকে জমশ্বেরপুর স্কুলের সমস্ত গোপনীয় এবং অফিসীয়াল কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন। স্কুলের শিক্ষকতা এবং এডমিনিস্ট্রেটিভ দায়িত্ব পালনের কাজ ছাড়াও মোতাহ্হার সাহেবের চাচা রৌফ সাহেবের বিশেষ অনুরোধে উনাকে জমশ্বেরপুর পোষ্ট অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্বও নাম মাত্র সম্মানীতে পালন করতে হয়েছে! পোষ্ট অফিসের সমস্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অতিরিক্ত পেপার ওয়ার্কের কাজগুলো উনি বাড়িতে বসে করতেন!
এজন্যে কোনদিন উনি অতিরিক্ত বেতন দাবী করেন নি এবং এর জন্যে কোন অভিযোগও করেন নি কখনো। মোতাহ্হার সাহেবের মনে অর্থ কড়ির প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। কোন কিছু বিনিময়ের আশা না করে নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের তথা সমাজের সার্বিক উপকার করাই ছিলো উনার কাছে মূখ্য বিষয়। জনাব মোতাহার প্রশ্নাতীত ভাবে তিনগ্রামের মসজিদ, ঈদগাঁ এবং কবরস্থান কমিটির cashier ছিলেন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের আগে পরে কোন এক সময় তাঁর prostatic operation কালীন সময়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং মাসাধিক কাল অবস্থান করেন। এসময় তিনি cashier এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। সেকালে ঐ অপারেশনটা জীবন মৃত্যুর বিষয় ছিল। জার্মানির এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা: নোভাক ঐ অপারেশনটা করেছিলেন। এলাকাবাসীর অকৃত্রিম দোয়ার ফলে আল্লাহর অসীম রহমতের কারনে উনি এই জটিল মরনঘাতি অপারেশন থেকে সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
এ তো গেলো মোতাহার মৌলভী সাহেবের দাপ্তরিক কাজের প্রতি নির্লোভ একাগ্র মনোনিবেশের কথা। এবার উনার ক্যারিশম্যাটিক শিক্ষকতা নিয়ে দু একটি কথা বলছি! জমশ্বেরপুর হাইস্কুলের ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের শিক্ষক হিসাবে উনি ছিলেন সোনা ফলানোর কারিগর। একটা নিভৃত পল্লীর অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়েদেরকে উনার সযত্ন পরিশিলীত পাঠদানের যাদুকরী ক্ষমতায় ইংরেজী গ্রামারের যে শক্ত ভিত তৈরী করে দিতেন, তা সেই ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত চলার পথে বিশাল সহায়ক হিসাবে কাজ করতো।
উনার কৃতি ছাত্র/ছাত্রীরা পরবর্তীতে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রের সর্বোচ্চ সন্মানিত শীর্ষ পদে অবস্থান করাকালীন সময়ে মোতাহার সাহেবের সেই ইংরেজী গ্রামারের শক্ত ভিত্তি তৈরী করে দেবার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে সবার কাছে বারবার বলে বেড়াতেন। ক্লাশরুমে নিরলস পাঠদানের পরও ছাত্র ছাত্রীদের বিশেষ অনুরোধের প্রেক্ষিতে উপরের ক্লাশের প্রচুর ছাত্র ছাত্রী উনার কাছে বাড়িতে এসে প্রায় বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়তো! কেউ কেউ যদি খুশি হয়ে ৫/১০ টাকা দিতো উনি লজ্জিত ভাবে সেটা নিতেন, কিন্তু কাউকে কোনদিন টাকা পয়সা দেবার কথা ভুলেও উচ্চারণ করতেন না! এমনই নির্লোভ আগাগোড়াই সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু মানুষের উপকার করাই ছিলো উনার একমাত্র ব্রত!
ছোট বড় নির্বিশেষে অত্র অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি যে অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন এ প্রসংগে একটি ঘটনার বর্ননা দিলে বুঝতে সুবিধা হবে, অত্র অঞ্চলের মানুষ উনাকে কতটা ভালবাসতেন! আপনারা সবাই জানেন, মেহারী, বর্ণী এবং কালসার, এই তিন গ্রামের যৌথ তত্তাবধানে কেবিএম নামে একটি একক সোসাইটি গড়ে নিয়ে তিন গ্রামে তিনটি বৃহৎ স্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে মেহারী গ্রামে আছে কেবিএম ঈদগাঁ, বর্ণী গ্রামে আছে কেবিএম জামে মসজিদ এবং কালসার গ্রামে আছে কেবিএম কবরস্থান! ঈদের দিনে তাই তিন গ্রামের সবাই ঈদগাঁয়ে জমায়েত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকে, জুম্মার দিনেও তিন গ্রামের সবাই মিলে কেন্দ্রীয় মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় থাকে, আর সবার শেষ ঠিকানা নির্ধারিত হয় কালসার গ্রামে অবস্থিত “উসনাকান্দির” এজমালী সেই কবরস্থানে! তো অনেক দিন আগের সত্তরের দশকের শেষ দিকের কথা, এক বছর ঈদের দিনে যথারীতি তিন গাঁয়ের সবাই একত্রিত হয়েছে ঈদগাঁয়ে নামাজ আদায়ের জন্যে।
বয়স একটু বেশি হলেও নিজে নিজে চলাফেরা করার পূর্ণ ক্ষমতা ছিল মোতাহ্হার সাহেবের। উনি সে বছর ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য খলামুরির কোল ঘেষে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে এসে উপস্থিত হলেন উনার প্রিয় বাঁকা বেতের লাঠিটি নিয়ে!
সে বছর তিন গ্রামের এজমালি মসজিদের প্রধান ইমাম সাহেব হুজুর অনেক বছর পর ঈদের ছুটিতে উনার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালি গিয়েছেন! এমনিতে ইমাম সাহেব হুজুর থাকলে শতসিদ্ধ নিয়মে তিনিই ঈদের নামাজের ইমামতি করে থাকেন। তো সে বছর ইমাম সাহেবের অনুপস্থিতিতে বিকল্প ইমামের ব্যবস্থার হোম ওয়ার্ক না করে কোনরূপ পূর্ব সিদ্ধান্ত ছাড়াই সবাই ঈদের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে ঈদগাঁতে উপস্থিত হলে হটাৎ করেই ঈদের নামাজের ইমামতি কে করবে এটা নিয়ে তিন গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর লোকজনদের মধ্যে আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে তুমুল বাক বিতন্ডা শুরু হয়ে যায়। তিন গ্রামের মধ্য থেকে সম্ভ্রান্ত মুরুব্বী জাতীয় কোন ব্যক্তিকে কিংবা মাওলানা টাইপের যাকেই ইমামতির জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছিলো, সাথে সাথেই অন্য গ্রামের লোকজন প্রবল বিরোধীতা করে তা নাকচ করে দিচ্ছিলো। অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো যে, ঈদের খুশির আনন্দ যে কোন মূহুর্তে বিষাদের রণক্ষেত্রে পরিনত হয়ে একটা খুনাখুনিতে রূপ নিতে পারে! তিন গ্রামেরই লাঠিয়াল টাইপের যুবকেরা রাম দা, মুলি, কুচ, বল্লম আর লাঠিসোটা প্রস্তুত করে ঈদগাঁতে নিয়ে আসার কথা একে অপরকে বলাবলি শুরু করে দেয়! কেবিএম সোসাইটির কেন্দ্রীয় ঈদগাঁটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অরক্ষিত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়! কোন অবস্থাতেই কাউকে পাওয়া যাচ্ছিলো না, যার সার্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে! তর্কাতর্কি এবং বিরোধীতার এক পর্যায়ে ইমামতীর ইস্যুটি প্রত্যেক গ্রামের লোকদের কাছে তাদের নিজস্ব গ্রামের মান সন্মানের ইগোতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো!
যার ফলে নিজ গ্রামের কোন মুরুব্বী ছাড়া ইমামতীর ভার অন্য গ্রামের কাউকেই দেয়ার মত অবস্থায় কেউ ছিল না! অবস্থাটা এমন হয়েছিলো সেই প্রবাদ বাক্যটির মতো যে, “ বিনাযুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী”! ঈদগাঁ লাগোয়া খলামুরির দক্ষিনের খিলক্ষেতটিতে রণক্ষেত্রের সম্ভাব্য মাঠও নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছিল! এই যখন সেখানকার সার্বিক অবস্থা, তখন আল্লাহর তরফ থেকে সমাধানের ফয়সালা স্বরূপ মোতাহার সাহেবের দক্ষিনের বাড়ির উনারই ভাতিজা ছামাদ মিয়া সকলের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য হটাত করে, “ভাইসব আপনারা সবাই থামেন” বলে হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন! উনার হুংকারে ঈদগাঁয়ের শোরগোল হটাত করেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সবাই উনার দিকে ফিরে তাকায়! উনি দাঁড়িয়েই খুব চমৎকার করে ভূমিকা নিয়ে বলা শুরু করলেন, ঈদের দিনের মতো এমন একটা খুশির দিনে আমরা সকলে যদি কাইজ্জা ফ্যাসাদে লিপ্ত হই তাহলে আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের সকলের উপর লা’নৎ এবং গজব বর্ষিত হবে। এরপর উনি বললেন, আমি আজকের এই অচল অবস্থা নিরসনে আপনাদেরকে এমন একজনের নাম প্রস্তাব করবো, আপনাদের যদি কারো কোন আপত্তি না থাকে, তবে উনি আজকে আমাদের ঈদের নামাজের ইমামতি করবেন! সবাই একযোগে বলে উঠলো কে সেই ব্যক্তি? নাম কও, নাম কও? তখন সামাদ সাহেব বেশ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে দৃঢ়ভাবে বললেন, আমার মোতাহার মৌলভি চাচা যদি নামাজ পড়ায় তাইলে কি কারো আপত্তি আছে? দীর্ঘ খরার পরে এক পশলা বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে পরম স্বস্তি প্রদান করে, উনার এই প্রস্তাবটিও তেমনি তিন গ্রামের মানুষকে নিমিষেই পরম স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিলো। সবাই সমস্বরে এক বাক্যে বললো যে, মোতাহার সাহেবের ব্যাপারে কারো কোন আপত্তি থাকার প্রশ্নই উঠে না!
একটা মানুষও পাওয়া গেলো না যে বলবে, না মানি না! আসলে শুধু তিন গ্রাম কেন যদি কসবা থানার সবগুলো গ্রাম নিয়ে কোন কেন্দ্রীয় মসজিদে এই ঘটনা ঘটতো, সেখানেও একটা মানুষ পাওয়া যেতো না যে মোতাহার সাহেবের ইমামতিতে নামাজ আদায়ে আপত্তি উত্থাপন করবে! এই ধরনের ক্লীন ইমেজ ছিলো উনার! যা হোক সে সময় বেশ কয়েকজন মুরুব্বী ধাচের মাতবর শ্রেণীর মানুষজন বিষ্ময় প্রকাশ করে বলাবলি করতে লাগলেন, মোতাহার চাচার কথা কেন আমাদের আগে মনে পড়লো না! আসলে মনে পড়বেই বা কি করে! আজীবন নিভৃতচারী মানুষটি ছিলো সব ধরনের কৃতিত্ব জাহির করার বিপক্ষে! এজন্যেই তিনি সেদিন ঈদগাঁয়ের এক কোনে নিঃশব্দে গুটিশুটি মেরে বাড়ি থেকে আনা পাটীতে চুপটি করে বসে ছিলেন! উনার ভাতিজা ছামাদ মিয়া উনাকে দূর থেকে দেখে দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করেই প্রস্তাব উত্থাপন করে বসেন। কারন ছামাদ সাহেব বেশ ভাল করেই জানতেন যে, উনার মোতাহার চাচার ইমামতীর ব্যাপারে তিন গ্রামের একটা মানুষও কোন আপত্তি করবে না! এরপর চাচার কাছে এসে উনাকে মিম্বরে যাবার জন্য অনুরোধ করেন। মোতাহার সাহেব অবশ্য নামাজের ইমামতিতে সম্মতি প্রদান করেন কিন্তু বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে অন্য আরেকজনকে খুৎবা পড়ার জন্য পছন্দ করেন। যেহেতু উনার পছন্দে খুৎবা পাঠক নির্ধারণ হয়েছে, সুতরাং এতে কেউ কোন প্রকার আপত্তি করেনি।
সেদিন যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে তিনটি গ্রাম রক্ষা পেয়েছিলো, তা ছিল শুধুমাত্র মোতাহার সাহেবের শ্বেত শুভ্র ক্লীন ইমেজের কারনে সমাজের সর্বস্তরের কাছে নিবিড় গ্রহনযোগ্যতার জন্যেই। সেদিন এই তিনটি গ্রাম শুধু খুনাখুনি থেকেই রক্ষা পায়নি, সেই সাথে আবহমান কাল ধরে চলে আসা তিন গ্রামের সৌহার্দের সেতুবন্ধনটিও ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম থেকে রক্ষা পেয়ে ছিলো!