ওয়ালিউর রহমান
যাপিত জীবনে পরশ পাথর ছিলে
সোনা ফলেছিলো যা কিছু ছুঁয়েছিলে!
পার্থিব সব গুনের আধার নিয়ে
রাঙ্গালে ভূবন সবটুকু তার দিয়ে!
এবার মোতাহ্হার সাহেবের সততা নিয়ে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করবো। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। সে সময় মেহারী গ্রামের মৌলভি বাড়ির আব্দুস সোবহান সাহেবের কলিকাতায় একটি বইয়ের লাইব্রেরী ছিল। ইসলামীয়া লাইব্রেরী নামের এই লাইব্রেরী থেকে একবার জমশ্বেরপুর স্কুলের জন্য বেশ কিছু বই কেনা হয়েছিল। রউফ সাহেব উনার ভাতিজা মোতাহ্হার সাহেবকে দায়িত্ব এবং অর্থ দিয়ে কলিকাতা পাঠিয়েছিলেন। তালিকা অনুযায়ী বই কেনার পর দেখা গেলো ৬ আনা পয়সার শর্ট পরে যায়। মোতাহ্হার সাহেব যেহেতু সোবহান সাহেবের নিজ এলাকার লোক এবং অত্যন্ত সুপরিচিত আত্মীয়সম তাই এই ৬ আনা পয়সা বাকীতে বইগুলো দিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর দিন যায় মাস যায় বছর যায়। কালের স্রোতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। কলিকাতা ভিন্ন দেশের মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়। সোবহান সাহেবের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্কুলের বই কেনার জন্যে যে ৬ আনা পয়সা বাকী রয়ে গিয়েছিলো মোতাহ্হার সাহেবের হৃদয়ে এই দেনাটি একটি বিষকাটা হয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। যদিও ওটা উনার ব্যক্তিগত কোন দেনা ছিল না, তথাপি উনি নিজের মনে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। বহু বছর পরে জীবন সায়াহ্নে এসে এই বিষয়টি উনার মনকে অনুসূচনার অনলে দগ্ধ করতে থাকে। কিভাবে এই দেনার দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন এটা নিয়ে দিনরাত আক্ষেপ করতে থাকেন। ততদিনে আব্দুস সোবহান সাহেব তো মৃত্যু বরন করেনই উনার ছেলেরাও কেউ আর বেঁচে নেই।
ঠিক সেই সময়ে মোতাহ্হার সাহেব উনার ভাতিজা আতাউর রহমান লিটনকে বাসায় ডেকে এনে সোবহান সাহেবের বংশধরদের কারো সাথে দেখা করে সেই ৬ আনা পয়সার ঋণ পরিশোধ অথবা মওকুফ কিংবা এর জন্য মাফ চাইতে পারা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করেন। উনার ভাতিজা লিটন তখন বিষয়টি কিভাবে ফয়সালা করা যায় তা দেখবে বলে মোতাহ্হার সাহেবকে আশ্বস্ত করলো। এরপর লিটন তার ভাতিজা দক্ষিনের বাডির আজাদ, যে তখন পুরান ঢাকার বাংলা বাজারে কর্মরত ছিল তার সাথে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে। তারা উভয়ে সিদ্ধান্ত নিলো যে সোবহান সাহেবের ছেলের ঘরের নাতী তৎকালীন ঢাকা সিটির ডেপুটি মেয়র জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের সাথে দেখা করে ৬ আনা পয়সার দেনাটি মোতাহ্হার সাহেবের পক্ষ থেকে মাফ করিয়ে আনবে। পূর্ব নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী লিটন এবং আজাদ একদিন সকাল বেলা জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল সাহেবের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর যখন তাদের সাক্ষাত ঘটে তখন লিটন এবং আজাদ উভয়েই সম্পূর্ণ ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বর্ননা দেয়। ওদের মুখে মোতাহ্হার সাহেবের সততার গুনাবলীর কথা শুনে আদেল সাহেব বিষ্ময় প্রকাশ করেন। এমন ভাল মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে এখনও আছে, এটা আদেল সাহেবের মনকে উদ্বেলিত করে তুলে। তিনি এই ক্ষনজন্মা পুরুষটিকে স্বচক্ষে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। উনি লিটন এবং আজাদকে বললেন মোতাহ্হার সাহেবের সাথে নিজে এসে দেখা করে সেই ৬ আনার ব্যাপারে কথা বলতে চান। সে অনুযায়ী দিনক্ষন ঠিক করে একদিন আদেল সাহেব আসলেন মোতাহ্হার সাহেবের ছেলের বাসা মিরপুরে দেখা করতে। আদিল সাহেব আসলেন, বসলেন এবং দীর্ঘক্ষন মোতাহ্হার সাহেবের সাথে কথা বলে অতীত ইতিহাস রোমন্থন করলেন। যাবার সময় মোতাহ্হার সাহেবকে জড়িয়ে ধরে সেই ৬ আনা পয়সা শুধু মাফ করে দিলেনই না, উল্টা উনার কাছে ক্ষমা এবং দোয়া চেয়ে বিদায় নিলেন।
যে মানুষটি স্কুলের বই কেনা বাবদ ৫০/৬০ বছর পূর্বের মাত্র ৬ আনা পয়সার ঋণের দায়কে নিজের মনে করে মানসিক যন্ত্রনায় ভুগে থাকেন, তিনি কতটা উত্তম চরিত্রের অধিকারী তা সহজেই অনুমেয়।
মোতাহ্হার সাহেব তার দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম কর্ম করতেন একাগ্র মনে নিষ্ঠার সাথে। শরিয়ত তরিকা অনুসরনের প্রতি ছিল উনার আপোষহীন অনড় অবস্থান। বৃষ্টি বিহীন কিংবা কড়া রোদ ছাড়াই স্বাভাবিক দিনেও উনি নিজের পর্দা রক্ষার্থে টুপির উপর সাদা স্কার্ফের মতো একখন্ড কাপড় জড়িয়ে রেখে ছাতা মাথায় গ্রামের মধ্যে চলাফেরা করতেন। গ্রামের কারো বাড়িতে কোন প্রয়োজনে যদি কখনো যেতেন, তবে বার বাড়ির ঘাটা থেকে সেই বাড়ির মানুষটির পূর্ন নাম ধরে খুব মিহি কন্ঠে ডাক দিতেন। কখনো যদি সেই লোকের অনুপস্থিতিতে কোন মহিলা এসে কথা বলতো, তৎক্ষনাত মোতাহ্হার সাহেব উনার ছাতাটিকে যথাসম্ভব নীচু করে ধরে নিজের মুখ আড়াল করে প্রয়োজনীয় কথাটি বলে সেখান থেকে চলে আসতেন। বর্ণী কালসার মেহারী গ্রামের সকলেই উনার আত্মীয়ের মতো এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাই কারো বাড়িতে উনি গেলে সেই বাড়ির লোকজন উনাকে ঘরে নিয়ে বসিয়ে অন্তত এক গ্লাস শরবত খাওয়াতে উদগ্রীব হয়ে যেতো। কিন্তু মোতাহ্হার সাহেব বিনয়ের সাথে তা পরিহার করতেন। তবে বর্ণী কালসার মেহারী জমশ্বেরপুর এই গ্রামগুলোর মানুষজন এমন পূন্যবান লোকের দোয়া পেতে সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকতো। তাইতো দেখা যেতো প্রায় দিনই এই গ্রামগুলোর কোন না কোন বাড়িতে তাদের যে কোন উপলক্ষ্যে উনাকে স্বসন্মানে দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন উনার দোয়া নেবার জন্য। সেখানেও মোতাহ্হার সাহেবের কঠিন শর্ত দেয়া থাকতো। দাওয়াত নেবার আগে উনি নিশ্চিত হয়ে নিতেন যে, যে বাড়িতে যাচ্ছেন সে বাড়ির লোকজন এবং যিনি রান্না করবেন তিনি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন কিনা। শর্ত পূরন হলেই কেবল উনি খাবারের দাওয়াত রাখতেন। নতুবা এমনিতেই সেই বাড়িতে গিয়ে কোন খাবার মুখে না দিয়েই শুধু দোয়া করে চলে আসতেন। আর সবাইকে নিয়মিত নামাজ পড়ার তাগিদ দিয়ে আসতেন।
অতি প্রত্যুষে ফজরের নামাজ আদায় শেষে রশি ঘরের দরজার কাছের চৌকিটিতে বসে সুর করে বিভিন্ন দোয়া কালাম পড়তে পড়তে ভোরের সুর্য উদয় হতো। আর বিকাল বেলায় আসরের নামাজ আদায় করে সেই একই জায়গায় বসে তসবীহ জপার সাথে সাথে কুরআন শরীফের আয়াত সুর করে পড়তেন মাগরিবের নামাজের আগ পর্যন্ত। এভাবেই উনার জীবনের প্রতিটি দিন আল্লাহর কালাম পাঠের মধ্য দিয়ে সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্ত হতো। দোয়ার উচ্চারণ এতটাই সশব্দে ছিল যে আশেপাশের বাড়ি থেকে তা স্পস্ট শোনা যেতো। আয়াতুল কুরসী থেকে শুরু করে সুরা ইয়াসিন, সুরা আর রহমান সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুরার চুম্বক অংশ সহীহ শুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করতেন। উনার প্রতিদিনের পড়া শুনে শুনে উনার বাড়ির ছেলেমেয়েদের এই সমস্ত সুরাগুলো এক পর্যায়ে মুখস্ত হয়ে যায়। কোন পার্থিব প্রলোভন মোতাহ্হার সাহেবকে তার এই দোয়া কালাম পড়ার রুটিন থেকে একদিনের জন্যও বিচ্যুত করতে পারেনি।
মোতাহ্হার সাহেবের সমগ্র জীবন ছিল এমন সৎ এবং নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট দ্বারা গঠিত।এমন একজন খাঁটি মানুষের জীবন চরিত নিয়ে বর্তমান প্রযন্মের ছেলেমেয়েরা যতই জানতে পারবে ততই নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারবে। পরিশেষে উপস্থিত সকলের কাছে অনুরোধ রইলো এই মহান মানুষটির জন্য কায়মনো বাক্যে দোয়া করবেন এবং উনার প্রদর্শিত পথ অনুসরন করে অত্র অঞ্চলের বর্তমান প্রযন্মকে সত্যিকার ভাবে সামাজিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টে সমৃদ্ধ করতে আন্তরিকভাবে উৎসাহিত করে যাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষন ধৈর্য ধারন করে মোতাহ্হার সাহেবের জীবন চরিতের উপর মূল্যবান কথাগুলো পড়ার জন্যে।